রুবাইদ মেহেদী

নিজেকে যায় না চেনা, আয়নার মিথ্যে শ্লোগানে...

বোকা মানুষটা

চিঠি
বোধ

(ছবিটির সত্ত্ব ও কৃতিত্বঃ সুমিত ব্যানার্জী, https://flic.kr/p/2iuig8g )


“আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।”

উনিশশো চৌত্রিশের, জীবনানন্দ দাশ, অপ্রকাশিত

জীবন এতোটা সহজ হয় না কখনো। গভীরভাবে অচল বোকা-মানুষের যায়গা এই পৃথিবীতে নেই। তাবৎ বিংশ শতক জুড়ে কলকাতায় একটিই ট্রাম দুর্ঘটনা হলো, একজন মানুষই মারা গেল। সে জীবনানন্দ দাশ, পৃথিবীর বোকা মানুষের প্রতিনিধি, পৃথিবীর অচলতম মানুষ।
“যে কবিই নয়, তাকে নিয়ে কবিতার সংখ্যায় আয়োজন কেনো!” এমন বিদ্রূপ আজ কোন ধুলোঝড়ে হারিয়েছে, কে জানে। অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়, আরো কোন বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে আজকের মানুষেরা ভাষা খোঁজে জীবনানন্দে। আজকের মানুষেরাও অবচেতনে আওড়ায়-

“মৃত্যুরে কে মনে রাখে ?… কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস
নতুন ডাঙার দিকে – পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা
দিন তার কেটে যায় – শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?”

মনে হয় একদিন, জীবনানন্দ দাশ

” যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের – মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা!”- পত্রিকার পাতায় আজো বোহেমিয়ান শিরোনাম উঠে আসে। অথচ, ঠিক কি কারণে বা কেমন অকারণে, আট বছর আগে মাঝরাতে সেই আচেনা গৃহী মানুষটা বধু-সন্তান ছেড়ে অশ্বত্থের ডাল ধরে সোজা লাশকাটা ঘরে চলে গেলো, বিস্তর তর্ক ফুরোয়। উত্তর মেলে না।

“ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন-যেন কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িংয়ের ঘন শিহরন
মরণের সাথে লড়িয়াছে,
চাঁদ ডুবে গেলে ’পরে প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের – মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা,
-এই জেনে।”

আট বছর আগের একদিন, জীবনানন্দ দাশ


মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস পূর্বে হুমায়ুন কবিরকে লেখা কবির কিছু উচ্চারণ আমাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়।

“আমি সেই মানুষ ,যে প্রচুর প্রতিকুলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কোনও কিছু- যা শেষ বিচারে একটা কোনও জিনিসের-মতন-জিনিস— কিন্তু , ভাগ্য এমনি যে, আজ তার পেটের ভাত জুটছে না। কিন্তু আশা করি একটা দিন আসবে যখন খাঁটি মুল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভাল দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।”

অধ্যক্ষ হুমায়ুন কবিরকে লেখা জীবনানন্দ দাশের চিঠি থেকে

আমি জানি, এ মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা ছিলনা। বরং বিশ্বাস করি এ ছিলো আত্মহত্যা কিংবা হত্যার প্রকারান্তর। মানুষ অথবা শাদা ডানা শঙ্খচিল জীবনানন্দকে পেলে জিজ্ঞেস করতেম,

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
কবি,
চিরকালই শকুন ও শেয়ালের খাদ্য কেন তাদের হৃদয়?

অদ্ভুত আঁধার এক, জীবনান্দ দাশ


আপনার সাথে যদি একটাবার দেখা করা যেতো!!

Facebook Comments