রুবাইদ মেহেদী

নিজেকে যায় না চেনা, আয়নার মিথ্যে শ্লোগানে...

 

ছেলেটার আরও একটা জীবন ছিলো।

সেই জীবনে বন্ধু ছিলো, প্রেম ছিলো, হাসি ছিলো, খেলা ছিলো, ছিলো আরো কত্ত কি।

ছেলেটা উড়তে ভালোবাসত, দেয়াল তার অসহ।

ছেলেটা সুখী ছিলো, সুখ তার তীব্র অহম।

সুখীতম মানুষের দাবী নিয়ে রাত ভর শহর দাপাত। একা একা ছুটে যেতো দেশের একেক প্রান্তে, এ শহরে, ও শহরে। রোমাঞ্চের নেশা ছিলো, সাগরে সখ্য ছিলো।

ছেলেটার ভাগ্য ছিলো।

ছেলেটার বন্ধুরা ছেলেটাকে এতো ভালোবেসেছে, পৃথিবীতে আর কেউ তেমনটা দ্যাখে নি কোথাও।

ছেলেটার প্রেমিকাটি ছেলেটাকে এতো ভালোবাসতো, ছেলেটা উপচে যেতো আবেগে।

ছেলেটাকে আমার হিংসে হতো, একটা মানুষ এতো ভালো কিভাবে থাকে?

ছেলেটা ফাঁকিবাজ ছিলো, ছেলেটার এক বন্ধু ছেলেটাকে ধরে পড়িয়ে পড়িয়ে সারা রাত জেগে সকালে পরীক্ষা দিতে পাঠিয়ে তারপর ঘুমোত। ছেলেটাকে জেতাবার জন্যে প্রিয় ফোনটা বাজী রাখতো আরেকটা বন্ধু। আরেকটা বন্ধু ছেলেটার ভাই হয়ে গিয়েছিলো। আরেকটা বন্ধু…..

নাহ, কেবল পাতা ভারী হবে, গল্পের শেষ হবে না।ছেলেটার ভাগ্য ছিলো।

যে প্রেমিকাটি ছেলেটাকে ঠকিয়েছে কিংবা যে প্রেমিকাটিকে ছেলেটা ঠকিয়েছে, কিংবা যে প্রেমিকাটি ছেলেটার বুঝে ওঠার ভুল ছিলো, তারা প্রত্যেকেই, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, তাকে ভালোবেসেছিলো যথেষ্ট-র বেশী। অন্তঃত ছেলেটা তা-ই বিশ্বাস করে।

ছেলেটার ভাগ্য ছিলো।

শেষমেষ যে বালিকাটি এসে তাকে তুমুল বাঁধলো আচানক, সেতো ক্ষুরধার সমুদ্র এনে ছাড়লো তার সাদামাটা বোহেমিয় জীবনে।

তবু, ছেলেটা ক্যামন জানি!

কিছুতেই কোন বিকার ছিলো না।

অমনোযোগে বন্ধুর বিষাদ কিংবা প্রেমিকার বুক ভাসা কান্না, সে উদাস অগ্রাহ্য করে যেতো।

জিজ্ঞেস করলে বলতো, “আমি তো এমনই।”

না, সে ঠিক উদাসীন ছিলো না। বা সব অগ্রাহ্য করে নিজে ভালো থাকবার মত মানুষও সে নয়।

হিসেব কিছুটা আলাদা এখানে।

যে কোন দহনে সে পুড়তো যথেষ্টই, হয়তো কিছুটা বেশীও। কিন্তু কাউকে বোঝাতে পারতো না, বা এ কাউকে বোঝানো সম্ভবও না, যে হ-য-ব-র-ল জীবনটাকে সে প্রতিনিয়ত অগ্রাহ্য করে হাসছে, গাইছে, যে তীব্র ব্যাথার ভ্রূকূটি অগ্রাহ্য করে সে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে, তার এই যত অনেক বেলার অভ্যাস, নরম মনের পাশেই আরেকটা শক্ত চাঙ্গর বেঁধেছে মেলাদিন।

সে বোঝাতে পারে না, এই পৃথিবীর সুখীতম মানুষটি সেই-ই।

এজন্য নয় যে, তার কোন শোক বা কষ্ট নেই। বরং তার শোক বা কষ্টের অনুভুতিরা প্রায় মরে গেছে, ভীষণ ভোতা হয়ে আছে বুকের ভিতর। কিছুতেই তার মুখ বিস্বাদ, তেতো হয়ে যায় না, এজন্যে নয় যে সে কখনো সন্দেশ আর আমিত্তি ছাড়া কিছু মুখে তোলে না। বরং তার স্বাদকুঁড়িগুলো অবশ হয়ে আছে যুগান্তর ধরে।

ছেলেটাকে কাঁদতে দেখেছি, বিশ্বাসের মৃত্যুতে কেঁদেছিলো।

ছেলেটাকে কাঁদতে দেখেছি, আস্থার পচন দেখে কেঁছিলো।

মানুষের অবনমনে কেঁদেছিলো একদিন।

আর কোন যন্ত্রণায় ছেলেটা কাঁদে না।

আর কিছুতেই কাঁদেনা, শুধু অদ্ভুত তামাশা করে।

অদ্ভুত হেয়ালী আর অবহেলা সব কিছুতেই।

কৌতুক করা তার নেশার মতন, সব কিছুতেই।

একবার একটা ইঞ্জেকশন দেবার আগে ডাক্তার তাকে বলেছিলো, এটা রিএকশন করলে তুমি কিন্তু এক মিনিটও সময় পাবে না।

ছেলেটা নগদে দাঁত বের দিল, “একটা মিনিট দাঁড়ান, তওবা করে নেই, বলাতো যায় না, কি হতে কি হয়”।প্রচন্ড সেরিব্রাল হেডেক নিয়ে প্যারালাইজডের মতো যখন হাসপাতালের বিছানায় পড়েছিলো, মা-টিকে ডেকে বলতো, “আমাকে চকোলেট এনে দেবে? ঐ ডাক্তারনীটাকে প্রপোজ করবো। দ্যাখো না, আমার পালস দ্যাখার ছুঁতোয় রোজ সকালে ক্যামন হাত ধরে বসে থাকে এসে।”একবার তো নিজের দোষেই ট্রাকের নিচে পড়তে পড়তে নিজেকে বলছিলো- “যাশশালা, গেইম ওভার হয়ে গেলো রে, তুমি তো শ্যাষ এইবার মানিক।” আর ঘাড়ের কাছে এসে ট্রাকটা হার্ড ব্রেক মেরে কোনমতে থামতেই, চিৎকার দিলোঃ “বোনাস লাইফ!! বোনাস লাইফ!!”

 

তার দর্শন খুব সাধারণ কিছু।

জীবনের প্রতিটা মুহুর্তই বোনাস।

কাল ভোরের সূর্যটা তুমি দেখবে কিনা তুমি জানো না। যদি না দেখো, তবে আজকের রাতটাই তোমার জীবনের শেষ রাত। জীবনের “হতেও পারে” শেষ রাতটা নিশ্চয়ই অর্থহীন দীর্ঘশ্বাসে নষ্ট করার কোন মানে হয় না।

 

ছেলেটা বেহুঁশ ছিলো, পাঢ় মাতালের মতো জীবনের অর্থহীন উদযাপনে একটু বেশীই মত্ত ছিলো।

 

ছেলেটার আর কিছুতেই হুঁশ ফেরেনি, জীবনভর আউড়েছে প্রিয়তম পংক্তিদেরঃ

 

“বাঁচবার ইচ্ছে এক অদ্ভুত অসুখ,মগজ কামড়ে খাওয়া অদ্ভুত অভিমানী পোকা”

 

|| অনীক || অগাস্ট ২৬, ২০১৩ ||

Facebook Comments